রাজউকের শাহেনশাহ গোল্ডেন মনির গ্রেফতার
দৈনিক সমসাময়িক প্রতিবেদন
২২ নভেম্বর, ২০২০
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এর প্লটের বাণিজ্য করে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির। প্রতিষ্ঠানটির গুলশান, বনানী, বারিধারা ও বাড্ডা প্রকল্পে তার কম করে হলেও তিন শতাধিক প্লট রয়েছে। সর্বশেষ পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে সিরাজ মেমোরিয়াল নামে তার বাবার নামে একটি স্কুল এবং গ্ল্যানিকেনস হাসপাতাল নির্মাণের প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন তিনি। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দ নেয়ার ক্ষেত্রে এ শাখার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প শাখার কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা একই এলাকার হওয়ার কারণে তারাই মূলত গোল্ডেন মনিরকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এ ছাড়া বারিধারায় তার কার সিলেকশনসহ তিনটি গাড়ির শোরুম রয়েছে। এসব গাড়ির শোরুমে পাশাপাশি চারটি প্লটের মালিক তিনি। এসব প্রতিটি প্লটের মূল্য কম করে হলেও ২০ কোটি টাকা। রাজউকের এস্টেট-২ শাখা সূত্রে জানা গেছে, রাজউকের উত্তরায় ‘জমজম’ টাওয়ারের কাছে আরো তিনটি বড় প্লটের মালিক গোল্ডেন মনির ও তার সিন্ডিকেট। এসব প্লটেও টাওয়ার বানানোর চিন্তা ভাবনা করছিলেন গোল্ডেন মনির। তবে রাজউক বহুমুখী সমবায় সমিতি’র কাছ থেকে একটি ১০ বিঘা আয়তনের প্লট নিয়েছেন গোল্ডেন মনির। এ বড় প্লটটির সাইনিং মানি দিয়েছেন ৫০ কোটি টাকা। করোনা পরিস্থিতির কারণে রাজউক সমবায় সমিতির জায়গায় ভবন নির্মাণে দেরি করছেন বলে জানা গেছে।
রাজউকের এস্টেট-১ শাখা সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির বাড্ডা প্রকল্পে গোল্ডেন মনির-এর শতাধিক প্লট রয়েছে। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকারের প্রথম মেয়াদে অনিয়মের অভিযোগে বাড্ডা প্রকল্পের প্লটগুলো বাতিল ঘোষণা করে সরকার। এ সুযোগ লুফে নেন গোল্ডেন মনির। তিনি কমদামে প্লটের মালিকদের প্লট কিনে নেন। এরপর মন্ত্রণালয়ে তদবির করেন। মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে বাতিল প্লটগুলো পুনর্বহাল করার ব্যবস্থা করেন গোল্ডেন মনির। এরপর রাজউকের সদস্য (এস্টেট ও ভূমি)-এর নেতৃত্বে পুনর্বহাল সংক্রান্ত কমিটি’র বৈঠকে শতাধিক প্লট জীবিত করার ব্যবস্থা করেন। এসব প্লট নামে-বেনামে গোল্ডেন মনির কিনে নিয়েছেন। এ ছাড়া রাজউকের বাড্ডা প্রকল্পের বেশির ভাগ প্লটের মালিক গোল্ডেন মনির। অনুসন্ধানে জানা গেছে, উত্তরার জমজম টাওয়ার-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির। এ টাওয়ারের মালিকানায় রয়েছে স্বর্ণ চোরাকারবারিদের একটি বড় সিন্ডিকেট। মূলত রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এর কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্যের সুযোগ নিয়ে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন মনির। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা তার কথায় উঠবস করেন। মন্ত্রণালয়ের ওই শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে এর আগে জিকে শামীমের কথা সবাই জানেন। কিন্তু একটি বিশেষ এলাকায় বাড়ি হওয়ার কারণে চুক্তিভিত্তিক ওই কর্মকর্তাকে কেউ কিছু বলার সাহস পান না। এ ছাড়া রাজউকের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. সাঈদ নূর আলমসহ অন্তত ডজনখানেক কর্মকর্তা গোল্ডেন মনিরকে দেখলে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান।
উল্লেখ্য, মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির। জীবনের শুরুটা ছিল অনেকটাই সাদামাটা। নব্বই দশকের দিকে ঢাকার গাউছিয়া মার্কেটে একটি কাপড়ের দোকানে অল্প বেতনে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। কিছুদিন পর মৌচাক মার্কেটের একটি ক্রোকারিজের দোকানে কাজ নেন। ক্রোকারিজের দোকানে কাজ করার সময় পরিচয় হয় এক লাগেজ কারবারির সঙ্গে। তারপর থেকেই মনিরের জীবনের মোড় ঘুরতে থাকে। ওই লাগেজ ব্যবসায়ীর সহযোগিতায় মনির নিজেই লাগেজ কারবারে নেমে পড়েন। দ্রুত লাভের মুখ দেখায় ব্যবসায় মনোযোগ দেন। কাপড় থেকে শুরু করে কসমেটিক, ঘড়ি, ইলেকট্রনিক ও কম্পিউটার সামগ্রীসহ আরো অনেক কিছুই আমদানি করতেন। তবে যা কিছুই আমদানি করতেন সেটি বৈধভাবে নয় সরকারি ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে আনতেন। এরপর তিনি স্বর্ণ চোরাকারবারে জড়িয়ে পড়েন। পরের কাহিনী অনেকেরই জানা। নিজের নামের আগে যেমন গোল্ডেন লেগেছে ঠিক তেমনি তার পুরো জীবনটাও স্বর্ণময় করে রেখেছিলেন। এখন তিনি আন্তর্জাতিক সোনা চোরাকারবারি হিসেবে পরিচিত। কি নেই তার? হুন্ডি ব্যবসা, সোনা চোরাচালান, ভূমিদস্যুতা, টেন্ডারবাজি ও সরকারি জমি বাগিয়ে নিয়ে গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল, বাড়ি, গাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। রয়েছে ব্যাংকভর্তি টাকা। হালে নিজ এলাকায় তিনি দানবীর হিসেবে পরিচিত। জনশ্রুতি আছে করোনাকালে তিনি নীরবে ৫০ কোটি টাকা খরচ করেছেন। অথচ তার অপকর্মের খতিয়ান দেখলে যে কেউ আঁতকে উঠবে।
সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে গোল্ডেন মনির চলাফেরা করেন তিন কোটি টাকা দামের গাড়িতে। এমন দামের ল্যান্ড ক্রজারের দুটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ- ১৫-৭০০৭ ও ঢাকা মেট্রো-ঘ-৪৪৪৪) তিনি নিয়মিত ব্যবহার করেন। এই দুটি গাড়ির কোনো বৈধ কাগজপত্র তিনি দেখাতে পারেননি বলে র্যাব জানিয়ছে। অনুমোদনহীন এই দুটি গাড়িই জব্দ করেছে র্যাব। এছাড়া তার অটো কার সিলেকশন শো-রুম থেকে আরও তিনটিসহ মোট পাঁচটি গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। এসব গাড়ি বিআরটিএ থেকে কিভাবে রেজিষ্ট্রেশন হয়েছে এখন এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। র্যাব জানায়, গোল্ডেন মনিরের দুটি বৈধ অস্ত্রের পাশপাশি একটি অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। এই অবৈধ অস্ত্রটি তিনি কি কাজে ব্যবহার করতেন সেটি খতিয়ে দেখছে র্যাব। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে আরও জানা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার স্বর্ণ চোরাকারবারীদের অন্যতম ছিলেন গোল্ডেন মনির। কর ফাঁকি দিয়ে তিনি কি পরিমাণ স্বর্ন দেশে নিয়ে এসেছেন তার হিসাব নাই। চোরাকারবারের সাপোর্টের জন্য তার ঢাকায় কয়েকটি স্বর্নের দোকান আছে বলে জানাগেছে। সিঙ্গাপুর, ভারত, দুবাই ও মালয়েশিয়া রুটে তিনি স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে আসতেন।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল ঢাকার মেরুল বাড্ডার ডিআইটি প্রজেক্টের ১৩ নম্বর রোডের ৪১ নম্বর বাড়ি থেকে গোল্ডেন মনিরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাড়িটিতে শুক্রবার রাত ১১টা থেকে গতকাল বেলা ১১টা পর্যন্ত মোট ১২ ঘণ্টার অভিযান চালায় র্যাব। র্যাব জানিয়েছে, একটি গোয়েন্দা সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে গোল্ডেন মনিরের নানা অপকর্মের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছে। পরে সেই তথ্য যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণ করে মেরুল বাড্ডার বাসায় অভিযান চালানো হয়। র্যাবের অভিযানিক দলের সদস্যরা বলেছেন, মনির আন্দাজ করতে পেরেছিলেন তার বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাই তিনি গতকালই ইকে-৫৮৫ ফ্লাইটে দুবাই যাবার সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। কিন্তু বিদেশ পালিয়ে যাবার আগেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। র্যাব সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিক তদন্তে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গোল্ডেন মনিরের দুই শতাধিক প্লটের সন্ধান মিলেছে। কেরানীগঞ্জ, বাড্ডা, পূর্বাচল, গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা এলাকাসহ আর কিছু এলাকায় এসব প্লট রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ডজন খানেক বাড়ি ও মার্কেট রয়েছে। এসব সম্পদের আনুমানিক মূল্য ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা। তবে র্যাব জানিয়েছে গোল্ডেন মনিরের প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ আরো অনেক বেশি। তার বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবের তথ্য এখনো মিলেনি। ধারণা করা হচ্ছে বিভিন্্ন ব্যাংক হিসাবে তার বিপুল পরিমাণ টাকা রয়েছে। এ ছাড়া বিদেশের অনেক দেশে তার নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে। এসব দেশে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সেকেন্ড হোম থাকতে পারে।
র্যাবের মুখপাত্র লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানিয়েছেন, মনির হোসেনের বাসা থেকে বিদেশি একটি পিস্তল, চার রাউন্ড গুলি, চার লিটার বিদেশি মদ, ৩২টি নকল সিল, ২০ হাজার ৫০০ সৌদি রিয়াল, ৫০১ ইউএস ডলার, ৫০০ চাইনিজ ইয়েন, ৫২০ রুপি, ১ হাজার সিঙ্গাপুরের ডলার, ২ লাখ ৮০ হাজার জাপানি ইয়েন, ৯২ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, হংকংয়ের ১০ ডলার, ১০ ইউএই দিরহাম, ৬৬০ থাই বাথ জব্দ করা হয়েছে। এগুলোর মূল্যমান ৮ লাখ ২৭ হাজার ৭৬৬ টাকা। এ ছাড়া ৬০০ ভরি (কেজি) স্বর্ণালংকার, নগদ ১ কোটি ৯ লাখ টাকা ও তার বাসার গ্যারেজ থেকে ৬ কোটি দামের দু’টি ল্যান্ড ক্রুজার এবং তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অটো কার সিলেকশন থেকে আরো তিনটি গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। পাঁচটি গাড়িই অনুমোদনহীন। র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির মুখপাত্র লে, কর্নেল আশিক বিল্লাহ আরও বলেছেন, গোল্ডেন মনিরের মানি লন্ডারিংয়ের জন্য সিআইডি, কর ফাঁকি দিয়ে পণ্য আমদানি করার জন্য এনবিআর, অবৈধ সম্পদ অর্জনের জন্য দুদক ও অনুমোদনহীন গাড়ি রেজিষ্ট্রেশনের বিষয়ে খোঁজ নিতে বিআরটিএ কে তারা চিঠি দিবেন। যাতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে পারে। এছাড়া তার বাসা থেকে বিদেশী মদ উদ্ধারের জন্য মাদক আইনে, অবৈধ অস্ত্র রাখার জন্য অস্ত্র আইনে ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে আরেকটি মামলা করা হবে।
র্যাব জানিয়েছে, চোরাচালানের দায়ে ২০০৭ সালে ঢাকার বিভিন্ন থানায় গোল্ডেন মনিরের নামে একাধিক মামলা হয়েছিল। সরকারি নথি চুরি করে সিল জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি জমি হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ২০১২ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) তার নামে মামলা করেছিল। ২০১৯ সালে অবৈধ সম্পদ অর্জনের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তার নামে একটি মামলা করেছিল। রাজউক ও দুদকের মামলা দুটি এখনও চলমান আছে। র্যাবসূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিক তদন্তেই গোল্ডেন মনিরের হাজার কোটি টাকার ওপরে অবৈধ সম্পদ রয়েছে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তার আরও অনেক বেশি সম্পদ রয়েছে। মনির রাজউক ও গণপূর্ত অধিদপ্তরে এক যুগের বেশি সময় ধরে আধিপত্য বিস্তার করে আসছিলেন। রাজউক ভবনে তার নামে একটি কক্ষ বরাদ্দ ছিল। ওই কক্ষে বসেই তিনি তার প্লট ভাগানোর কাজ হাসিল করতেন। বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ম্যানেইজড করে সরকারি নথি চুরি করতেন। পরে সিল ও সাক্ষর নকল করে প্লট নিজের নামে করে নিতেন। অভিযোগ আছে এই কৌশলে তিনি এখন পর্যন্ত আড়াই থেকে তিন শতাধিক প্লট নিজের করে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে যেসব কর্মকর্তা বাধার সৃষ্টি করতেন টাকা দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে রাখতেন। কাউকে আবার ভয়ভীতি দেখাতেন। অভিযোগ আছে গোল্ডেন মনিরের আধিপত্যর কাছে রাজউকের অনেক কর্মকর্তাই তটস্থ হয়ে থাকেন। শুধু রাজউক নয় তার ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। র্যাবের হাতে আগেই গ্রেপ্তার হওয়া টেন্ডারমোঘল জিকে শামীমের সঙ্গে গোল্ডেন মনিরের রেষারেষি অনেক দিনের। শিক্ষাভবন, গণপূর্ত অধিদপ্তরের এই টেন্ডারবাজদের কাহিনী সবাই জানতেন। জিকে শামীম র্যাব কর্তৃক গ্রেপ্তারের পর গণপূর্ত অধিদপ্তরে মনিরের রাজত্ব শুরু হয়। অভিযোগ আছে, বড় অংকের টাকার বিনিময়ে গণপূর্তের অনেক বড় বড় পদে নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের বদলি করাতেন মনির। পরে তাদের মাধ্যমেই স্বার্থ হাসিল করতেন।