যুক্তরাষ্ট্রে ভোর থেকেই ভোটারদের লাইন
দৈনিক সমসাময়িক প্রতিবেদন
০৩ নভেম্বর, ২০২০
যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় সাড়ে ২৩ কেটি ভোটারের মধ্যে প্রায় দশ কোটি আমেরিকান এরই মধ্যে আগাম ভোট দিয়েছেন, তবে নির্বাচনের দিনটিতে ব্যক্তিগতভাবে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার আলাদা একটি আবেগ রয়েছে। যে কারণে অনেক রাজ্যে প্রচুর ভোটার মঙ্গলবার ভোর থেকে ভোটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন। প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হতে হলে ইলেকটোরাল কলেজ বা নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে জিততে হবে। মোট ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। জিততে হলে এর মধ্যে ২৭০টি ভোট পেতে হবে। ভোট গণনা শেষ হতে কয়েকদিন সময় লাগতে পারে। তবে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর দ্রুতই একটা ট্রেন্ড স্পষ্ট হতে পারে। এএফপি জানিয়েছে, রাজধানী ওয়াশিংটনের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে হোয়াইট হাউস ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে সহিংসতা ও ভাংচুর থেকে নিজেদের সম্পদ সুরক্ষার জন্য দিনরাত কাজ করছেন ব্যবসায়ীরা। ভোটের দিন সামনে করে গত কয়েকদিন ধরে রাস্তার ধারের দোকানপাট ও ভবনগুলোর জানালা-দরজায় ও দেয়ালে দোকানিদের কাঠ ও বোর্ড লাগাতে দেখা গেছে।
শেষ পর্যন্ত নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে কিনা এবং ফলাফল গৃহীত হবে কিনা- তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে ভোটাররা। ইউএসএ টুডে ও সাফোক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ জরিপ মতে, চারজন ভোটারের মধ্যে তিনজনেরই আশঙ্কা নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা চলবে। ফ্লোরিডার পিটার্সবুর্গের এক রেজিস্টার্ড নার্স এ জরিপে অংশ নেন। ৭২ বছর বয়সী এ মার্কিন নাগরিক বলেন, ‘এ মুহূর্তে খুব চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। আমি আমার পুরো জীবনে এমন ভীতিকর পরিস্থিতি দেখেছি ১৯৬২ সালে জন এফ কেনেডির প্রেসিডেন্ট হওয়ার সময় এবং কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকট মুহূর্তে।’ এ ছাড়া নির্বাচনের ভুয়া খবর ছড়িয়ে সহিংসতা হতে পারে বলে উদ্বেগ জানিয়েছেন ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ। মার্কিন প্রশাসনকে সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘ভোট নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগে আছি। যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের মধ্যে মেরুকরণ হয়ে গেছে। চূড়ান্ত ফল বের হতে কয়েকদিন এমনকি কয়েক সপ্তাহও লাগতে পারে। এ অবস্থায় সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে।’
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের মধ্যে লড়াই চলছে। এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিভিন্ন জরিপ প্রকাশিত হয়েছে। এসব জরিপে প্রধান দুই প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেনের মধ্যে কে কোথায় কতটা এগিয়ে, তার ধারণা দেওয়া হয়েছে। রিয়েল ক্লিয়ার পলিটিকস জরিপে বলা হয়েছে, নির্বাচনে ট্রাম্প ও বাইডেনের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে যাচ্ছে। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটলগ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্যগুলোতে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান প্রার্থীর মধ্যে ব্যবধান কমে এসেছে। সোমবারের এই জরিপ অনুযায়ী, ব্যাটলগ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্যগুলোতে রিপাবলিকান ট্রাম্পের চেয়ে ডেমোক্র্যাট বাইডেন মাত্র ২ দশমিক ৯ পয়েন্টে এগিয়ে রয়েছেন। গত কয়েক দিনে বাইডেনের এগিয়ে থাকার ব্যবধান কমেছে। এদিকে রিয়েল ক্লিয়ার পলিটিকস জরিপ বলছে, জাতীয় পর্যায়েও বাইডেনের চেয়ে পিছিয়ে আছেন ট্রাম্প। এ ক্ষেত্রে বাইডেন ও ট্রাম্পের মধ্যকার ব্যবধান বেশি। এই ব্যবধান ৬ দশমিক ৫ পয়েন্ট। তবে এটা আগের চেয়ে কম। কিছুদিন আগেও বাইডেন প্রায় ৮ পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে তীব্র আকার ধারণ করেছে রাজনৈতিক উত্তেজনা। দেশজুড়ে বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা। দেখা দিয়েছে নজিরবিহীন সহিংসতা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও লুটপাটের আশঙ্কা। অনেক দোকান-পাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখন থেকেই ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন। তারা পিজবোর্ড দিয়ে দোকানের সামনের অংশ ঢেকে দিচ্ছেন সম্ভাব্য সহিংসতা এবং হামলা থেকে বাঁচতে। এরকম বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে স্যাকস, ফিফথ এভিনিউ, নোরডস্ট্রম এবং ফার্মেসি চেইন সিভিএস। ইতোমধ্যে কয়েকটি শহরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ভোটের দিন ও পরবর্তী দিনগুলোয় জ্বালাও-পোড়াও ও ভাংচুরের ভয়ে ঘরবাড়ি ছাড়ছে সাধারণ মার্কিনিরা। এদিকে সহিংসতা মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করছে বিভিন্ন রাজ্য সরকার। রাজ্যে রাজ্যে, শহরে শহরে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে পুলিশ।
বিবিসি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পরে কে বিজয়ী হয়েছেন, সেটা জানতে কয়েকদিন, এমনকি কয়েক সপ্তাহও লেগে যেতে পারে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এবারের নির্বাচনে প্রায় ১০ কোটি আমেরিকান ডাক যোগে ভোট দিয়েছেন। ফলে সব ভোট গণনা শেষ হতে দেরি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, সাধারণত নির্বাচনের দিন রাতেই ফলাফল সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে আলাদা আলাদা সময়ে ভোট গ্রহণ শেষ হবে। প্রথম ভোট শেষ হবে পূর্ব উপকূলের রাজ্যগুলোয়। নির্বাচনের রাতে সব ভোট গণনা শেষ না হলেও কে বিজয়ী হতে যাচ্ছে, তা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
মঙ্গলবার রাশিয়ায় চ্যানেল ওয়ান টিভির সকালের অনুষ্ঠানে বলা হয়, এই নির্বাচন এক দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সংকটে রূপ নিতে পারে। দেশটির অপর একটি চ্যানেল ‘রুশিয়া ২৪’ বলেছে, বিক্ষোভকারী আর লুটেরাদের কাছ থেকে রক্ষায় আমেরিকার সর্বত্র বিভিন্ন ভবন, দোকানপাটে এখন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এদিকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ সিবিএস টিভিকে যে সাক্ষাতকার দিয়েছেন, দেশটির ইংরেজি ভাষার টিভি চ্যানেল প্রেস টিভি সে বিষয়ে একটি খবর প্রচার করেছে। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের সঙ্গে বিদ্বেষমূলক আচরণ বন্ধ করে, তাহলে হোয়াইট হাউসে যিনিই থাকুন, পরিস্থিতি কিন্তু বদলে যাবে। এছাড়া আরব গণমাধ্যমে এই নির্বাচনের খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হচ্ছে। সৌদি আরবের আল আরাবিয়া টিভি বলেছে, অভূতপূর্বভাবে বিভক্ত এবং খুবই উত্তেজনাকর এক পরিবেশে এই নির্বাচন হচ্ছে, দাঙ্গা এবং বিক্ষোভের আশংকা করা হচ্ছে। তুরস্কের সরকারপন্থী গণমাধ্যমের খবরে মনে হচ্ছে যেন তারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচনের পক্ষে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বেশ উষ্ণ সম্পর্ক।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় নিয়ে ৫০ লাখ ডলারে বাজি ধরেছেন এক বৃটিশ জুয়াড়ি। এ বাজিতে তিনি জিতলে পাবেন এক কোটি ৫০ লাখ ডলার। ধারণা করা হচ্ছে, এ যাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংকের রাজনৈতিক বাজি এটি। ক্যারিবিয়ান দ্বীপ কুরাকাওতে বেসরকারিভাবে নিবন্ধিত সাবেক এক ব্যাংকার এই বাজি ধরেছেন। তিনি ট্রাম্পের নির্বাচনী শিবিরের সঙ্গে পরামর্শ করার পর এই বাজি ধরেছেন বলে জানা গেছে। তাতে তাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, ট্রাম্প নির্বাচনে জিতবেন। লন্ডনের অনলাইন দ্য সান’কে উদ্ধৃত করে এ খবর দিয়েছে নিউ ইয়র্ক পোস্ট। বাজির সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন একটি সূত্র জানিয়েছে, এটাই রাজনৈতিক সবচেয়ে বড় বাজি।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিতে বাজি অবৈধ হলেও বৃটেন সহ অনেক দেশে তা জনপ্রিয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের এ বছরের নির্বাচন সব সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাজিতে রূপ নিতে যাচ্ছে। বাজি বিষয়ক তুলনামূলক সাইট অডচেকার মঙ্গলবার বলেছে, যত মানুষ মার্কিন নির্বাচন নিয়ে বাজি ধরেছেন তাদের মধ্যে ৪ জনের ৩ জনই ট্রাম্পের পক্ষে বাজি ধরেছেন। তারা মনে করছেন, ট্রাম্প আরেক দফা ক্ষমতায় আসছেন। ফলে ট্রাম্পের জাগরণ দেখা দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে এই বাজিতে প্রথম চার ঘন্টায় বাজির শতকরা ৭১ ভাগ অর্থ এসেছে ট্রাম্পের ওপর বাজি থেকে। একে বিস্ময়কর বলে মন্তব্য করেছেন সাইটটির মার্কেটিং প্রধান স্যাম ইটন। তিনি বলেছেন, ২০১৬ সালে আমরা যে ধরনের নির্বাচন দেখেছি, এবারও সেই একই রকম নির্বাচন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। আমরা যতই নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, ততই ট্রাম্পের জন্য অর্থ আসছে এই বাজিতে। নির্বাচনের দিনে আরো প্রচুর জুয়ারি এতে অংশ নেবেন। পেডি পাওয়ার নামে এক বুকমেকার বলেছে, ট্রাম্প ইস্যুতে ২৪ ঘন্টায় উঠে এসেছে জুয়ার শতকরা ৯৩ ভাগ।